ঢাকা ০১:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জুমার প্রথম খুতবা: বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব

  • ইসলাম ডেস্ক:-
  • প্রকাশিত সময় :- ১২:৫১:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ মে ২০২৩
  • ২২০ পড়া হয়েছে। নিউজবিজয় ২৪.কম-১৫ ডিসেম্বরে ৯ বছরে পর্দাপন

আজ শুক্রবার। বরকতময় মাস শাওয়ালের শেষ জুমা আজ। ১৯ মে ২০২৩ ইংরেজি, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বাংলা, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৪ হিজরি। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব।

প্রিয় মুসল্লিগণ!
সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের হক একটি মহান দায়িত্ব। এ অধিকারের গুরুত্ব এত বেশি যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের হকের সঙ্গে মা-বাবার হককে মিলিত করেছেন। কারণ তিনি মা-বাবার মাধ্যমে জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ জন্ম নেওয়ার পর মহান আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত হয়। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ বাবা-মায়ের হকের বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেন-
وَ اعۡبُدُوا اللّٰهَ وَ لَا تُشۡرِکُوۡا بِهٖ شَیۡئًا وَّ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا
‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করো না এবং বাবা-মায়ের মঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।’ (সুরা আন-নিসা : আয়াত ৩৬)

এ আয়াতে কারিমায় মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করতেও নিষেধ করেছেন। পাশাপাশি বাবার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনে উত্তম আচরণ করারও নির্দেশ দিয়েছেন।
সুতরাং বাবা-মায়ের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও সদ্ব্যবহার করা ইসলামের অনুসারীদের ঈমানি দায়িত্ব ও কোরআনের নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার এবং কথা ও কাজে তাদের প্রতি সদয় আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সন্তানদের প্রতি সেই অসিয়াত করেছেন এবং তাদের থেকে এ বিষয়ে অঙ্গিকারও নিয়েছেন। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
وَ قَضٰی رَبُّکَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا ؕ اِمَّا یَبۡلُغَنَّ عِنۡدَکَ الۡکِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوۡ کِلٰهُمَا فَلَا تَقُلۡ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنۡهَرۡهُمَا وَ قُلۡ لَّهُمَا قَوۡلًا کَرِیۡمًا – وَ اخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحۡمَۃِ وَ قُلۡ
‘আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল-
رَّبِّ ارۡحَمۡهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیۡ صَغِیۡرًا
‘হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল: আয়াত ২৩-২৪)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন-
وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗا وَبِذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡجَارِ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡجَارِ ٱلۡجُنُبِ وَٱلصَّاحِبِ بِٱلۡجَنۢبِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِ
‘তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর ও কোনো কিছুকে তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করো না এবং মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, আত্মীয় ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার কর।’ (সুরা নিসা: আয়াত ৩৬)

তিনি অন্য জায়গায় বলেছেন-
وَوَصَّيۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ حُسۡنٗاۖ
‘আর আমি মানুষকে তার বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছি।’ (সুরা আনকাবুত: আয়াত ৮)

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন-
وَوَصَّيۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ حَمَلَتۡهُ أُمُّهُۥ وَهۡنًا عَلَىٰ وَهۡنٖ وَفِصَٰلُهُۥ فِي عَامَيۡنِ أَنِ ٱشۡكُرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيۡكَ إِلَيَّ ٱلۡمَصِيرُ
‘আমি তো মানুষকে তার বাবা-মায়ের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে এবং তার স্তন্যপান ছাড়াতে দু’বছর অতিবাহিত হয়। সুতরাং তুমি আমার প্রতি ও তোমার বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সুরা লোকমান: আয়াত ১৪)
আবার সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের দায়িত্ববোধ হলো- তারা সন্তানের লালন-পালন করবেন, তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা দেবেন। এমনকি তাদের সুখ-শান্তির জন্য নিজ আগ্রহ থেকেই রাতদিন পরিশ্রম করে থাকেন বাবা-মা।
হজরত আবু আব্দুর রাহমান আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম-
أيُّ العَمَلِ أحَبُّ إِلَى اللهِ تَعَالَى ؟ قَالَ: «الصَّلاةُ عَلَى وَقْتِهَا»، قُلْتُ : ثُمَّ أيٌّ ؟ قَالَ: «بِرُّ الوَالِدَيْنِ»، قُلْتُ : ثُمَّ أيٌّ؟ قَالَ: «الجِهَادُ في سبيلِ الله»
’কোন আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়?’ তিনি বললেন, ’যথা সময়ে নামাজ আদায় করা। আমি বললাম, ’তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ’বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করা।’ আমি বললাম, ’তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ’আল্লাহর পথে জিহাদ করা।’ (বুখারি ও মুসলিম)

সুতরাং ইসলামের এ বিধান সুস্পষ্ট যে, ইহসানের বিনিময় শুধুই ইহসান। এ কথাটিও মহান আল্লাহর। তিনি বলেছেন-
هَلۡ جَزَآءُ الۡاِحۡسَانِ اِلَّا الۡاِحۡسَانُ
‘উত্তম কাজের জন্য উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?
এ কারণেই প্রত্যেক সন্তানের উচিত, বাবা-মায়ের এ দায়িত্ববোধ পালনের কারণে তাদের প্রতি সদয় হওয়া। তাদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করা। কোরআনের নির্দেশ মেনে চলা। বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করা সন্তানের একান্ত হক বা অধিকার।

হজরত ইবনু আবি শায়বা মায়াজ একবার ইবনু জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- সন্তানের ওপর বাবা-মায়ের কি হক? উত্তরে তিনি বলেছিলেন- ‘তোমার সব ধন-সম্পদ যদি তাদের দিয়ে দাও তবুও তাঁদের হক আদায় করতে পারবে না।’

হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এক ইয়েমেনি ব্যক্তিকে এ অবস্থায় কাবা ঘর তওয়াফ করতে দেখলেন যে, তার পিঠে তার মাকে বহন করছেন আর বলছেন-
‘আমি (আমার মায়ের) বাধ্য উট স্বরূপ। যদিও উট তার সাওয়ারিকে ফেলে পলায়ন করে কিন্তু আমি ঐ রকম করবো না। এরপর ওই ব্যক্তি বললেন, হে ইবনু ওমর! আপনি কি মনে করেন যে, আমি আমার মাতার প্রতিদান দিয়েছি। তদুত্তরে তিনি বললেন, তোমাকে প্রসব করার সময় তার দীর্ঘ একটি শ্বাস কষ্টের প্রতিদানও দাওনি।

বাবা-মায়ের আনুগত্য করা ওয়াজিব
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার হজরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নয়টি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন। তার মধ্যে একটি হলো-
‘… তোমার বাবা-মায়ের আনুগত্য করো। যদি তাঁরা তোমাকে তোমার দুনিয়ার (যাবতীয় কাজ) থেকে বের হয়ে যেতে বলে তবে তাঁদের নির্দেশ পালনার্থে তাই করবে।… ’ (আদাবুল মুফরাদ)

আর যারা একান্তই মহান আল্লাহর নির্দেশ এবং বাবা-মায়ের প্রতি কোনো বিষয় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে না তাদের জন্য হাদিসে পাকে রয়েছে অভিশাপ ও কঠিন সতর্কবার্তা। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবাধ্য সন্তানের ব্যাপারে তিনবার বদ-দোয়ার কথা বলেছেন। এ সম্পর্কে হাদিসের দিকনির্দেশনা এমন-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সে ব্যক্তির নাক ধূলায় মলিন হোক, সে ব্যক্তির নাক ধূলায় মলিন হোক, সে ব্যক্তির নাক ধূলায় মলিন হোক; যে ব্যক্তি তার বাবা-মাকে উভয়কে কিংবা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় জীবিত পেলো; অথচ সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না।’ (মুসলিম)

মনে রাখতে হবে
বাবা-মায়ের সঙ্গে ইহসান তথা ন্যায়-সঙ্গত আচরণ ও আনুগত্য করা জরুরি। আর এর মাধ্যমেই জান্নাতের নিশ্চয়তা পাবে মুমিন। কেননা সন্তানের প্রধান দায়িত্বই হলো- বাবা-মায়ের আনুগত্য করা; তাদের প্রতি ইহসান করার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা করা। কারণ বাবা-মায়ের প্রতি অবাধ্যতাই হবে জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

তাই বাবা-মা জীবিত থাকলে তাদের খেদমত করবে। তাদের প্রতি দয়া দেখাবে। তাদের খোঁজ-খবর নেবে। জীবিত কিংবা মৃত সব বাবা-মায়ের জন্য সন্তান সব সময় এভাবে দোয়া করবে-
১. رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
উচ্চারণ : ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’
অর্থ : (হে আমাদের) পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া কর; যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৪)

২. رَبَّنَا ٱغْفِرْ لِى وَلِوَٰلِدَىَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ ٱلْحِسَابُ
উচ্চারণ : ‘রাব্বানাগফিরলি ওয়ালিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিলমুমিনিনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব।’
অর্থ : ‘হে আমাদের রব! যেদিন হিসাব কায়েম হবে, সেদিন আপনি আমাকে, আমার বাবা-মাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪১)

৩. رَّبِّ ٱغْفِرْ لِى وَلِوَٰلِدَىَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيْتِىَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَٰتِ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّٰلِمِينَ إِلَّا تَبَارًۢا
উচ্চারণ : ‘রাব্বিগফিরলি ওয়ালিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিমান দাখালা বাইতিয়া মুমিনাও ওয়া লিলমুমিনিনা ওয়াল মুমিনাত ওয়া লা তাযিদিজ জ্বালিমিনা ইল্লা তাবারা।’
অর্থ : ‘হে আমার রব! আমাকে, আমার বাবা-মাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন আর আপনি জালিমদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না।’ (সুরা নুহ : আয়াত ২৮)

বিশেষ করে
শুধু বাবা-মায়ের জন্য দোয়া ও খেদমতই নয় বরং বাবা-মায়ের আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখা জরুরি। বাবা-মায়ের আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সন্তানের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। হাদিসের বর্ণনা থেকে তা সুস্পষ্ট-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَصِلَ أَبَاهُ فِي قَبْرِهِ،فَلْيَصِلْ إِخْوَانَ أَبِيهِ بَعْدَهُ
‘যে ব্যক্তি তার বাবার সঙ্গে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালোবাসে, সে যেন বাবার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সুসম্পর্ক রাখে।’ (ইবন হিববান)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে বাবা-মায়ের খেদমত করার তাওফিক দান করুন। তাদের খেদমত করার এবং তাদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

নিউজবিজয়২৪/এফএইচএন

👉 নিউজবিজয় ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন ✅

আপনার সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার দিন।

NewsBijoy24.Com

নিউজবিজয়২৪.কম একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যভিত্তিক সংবাদ প্রকাশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। উৎসর্গ করলাম আমার বাবার নামে, যাঁর স্নেহ-সান্নিধ্যের পরশ পরিবারের সুখ-দু:খ,হাসি-কান্না,ব্যথা-বেদনার মাঝেও আপার শান্তিতে পরিবার তথা সমাজে মাথা উচুঁ করে নিজের অস্তিত্বকে মেলে ধরতে পেরেছি।

ইতিহাসের এই দিনে: ১৯শে মে.২০২৪

জুমার প্রথম খুতবা: বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব

প্রকাশিত সময় :- ১২:৫১:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ মে ২০২৩

আজ শুক্রবার। বরকতময় মাস শাওয়ালের শেষ জুমা আজ। ১৯ মে ২০২৩ ইংরেজি, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বাংলা, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৪ হিজরি। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব।

প্রিয় মুসল্লিগণ!
সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের হক একটি মহান দায়িত্ব। এ অধিকারের গুরুত্ব এত বেশি যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের হকের সঙ্গে মা-বাবার হককে মিলিত করেছেন। কারণ তিনি মা-বাবার মাধ্যমে জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ জন্ম নেওয়ার পর মহান আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত হয়। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ বাবা-মায়ের হকের বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেন-
وَ اعۡبُدُوا اللّٰهَ وَ لَا تُشۡرِکُوۡا بِهٖ شَیۡئًا وَّ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا
‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করো না এবং বাবা-মায়ের মঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।’ (সুরা আন-নিসা : আয়াত ৩৬)

এ আয়াতে কারিমায় মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করতেও নিষেধ করেছেন। পাশাপাশি বাবার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনে উত্তম আচরণ করারও নির্দেশ দিয়েছেন।
সুতরাং বাবা-মায়ের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও সদ্ব্যবহার করা ইসলামের অনুসারীদের ঈমানি দায়িত্ব ও কোরআনের নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার এবং কথা ও কাজে তাদের প্রতি সদয় আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সন্তানদের প্রতি সেই অসিয়াত করেছেন এবং তাদের থেকে এ বিষয়ে অঙ্গিকারও নিয়েছেন। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
وَ قَضٰی رَبُّکَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا ؕ اِمَّا یَبۡلُغَنَّ عِنۡدَکَ الۡکِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوۡ کِلٰهُمَا فَلَا تَقُلۡ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنۡهَرۡهُمَا وَ قُلۡ لَّهُمَا قَوۡلًا کَرِیۡمًا – وَ اخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحۡمَۃِ وَ قُلۡ
‘আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল-
رَّبِّ ارۡحَمۡهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیۡ صَغِیۡرًا
‘হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল: আয়াত ২৩-২৪)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন-
وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗا وَبِذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡجَارِ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡجَارِ ٱلۡجُنُبِ وَٱلصَّاحِبِ بِٱلۡجَنۢبِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِ
‘তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর ও কোনো কিছুকে তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করো না এবং মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, আত্মীয় ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার কর।’ (সুরা নিসা: আয়াত ৩৬)

তিনি অন্য জায়গায় বলেছেন-
وَوَصَّيۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ حُسۡنٗاۖ
‘আর আমি মানুষকে তার বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছি।’ (সুরা আনকাবুত: আয়াত ৮)

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন-
وَوَصَّيۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ حَمَلَتۡهُ أُمُّهُۥ وَهۡنًا عَلَىٰ وَهۡنٖ وَفِصَٰلُهُۥ فِي عَامَيۡنِ أَنِ ٱشۡكُرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيۡكَ إِلَيَّ ٱلۡمَصِيرُ
‘আমি তো মানুষকে তার বাবা-মায়ের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে এবং তার স্তন্যপান ছাড়াতে দু’বছর অতিবাহিত হয়। সুতরাং তুমি আমার প্রতি ও তোমার বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সুরা লোকমান: আয়াত ১৪)
আবার সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের দায়িত্ববোধ হলো- তারা সন্তানের লালন-পালন করবেন, তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা দেবেন। এমনকি তাদের সুখ-শান্তির জন্য নিজ আগ্রহ থেকেই রাতদিন পরিশ্রম করে থাকেন বাবা-মা।
হজরত আবু আব্দুর রাহমান আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম-
أيُّ العَمَلِ أحَبُّ إِلَى اللهِ تَعَالَى ؟ قَالَ: «الصَّلاةُ عَلَى وَقْتِهَا»، قُلْتُ : ثُمَّ أيٌّ ؟ قَالَ: «بِرُّ الوَالِدَيْنِ»، قُلْتُ : ثُمَّ أيٌّ؟ قَالَ: «الجِهَادُ في سبيلِ الله»
’কোন আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়?’ তিনি বললেন, ’যথা সময়ে নামাজ আদায় করা। আমি বললাম, ’তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ’বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করা।’ আমি বললাম, ’তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ’আল্লাহর পথে জিহাদ করা।’ (বুখারি ও মুসলিম)

সুতরাং ইসলামের এ বিধান সুস্পষ্ট যে, ইহসানের বিনিময় শুধুই ইহসান। এ কথাটিও মহান আল্লাহর। তিনি বলেছেন-
هَلۡ جَزَآءُ الۡاِحۡسَانِ اِلَّا الۡاِحۡسَانُ
‘উত্তম কাজের জন্য উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?
এ কারণেই প্রত্যেক সন্তানের উচিত, বাবা-মায়ের এ দায়িত্ববোধ পালনের কারণে তাদের প্রতি সদয় হওয়া। তাদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করা। কোরআনের নির্দেশ মেনে চলা। বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করা সন্তানের একান্ত হক বা অধিকার।

হজরত ইবনু আবি শায়বা মায়াজ একবার ইবনু জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- সন্তানের ওপর বাবা-মায়ের কি হক? উত্তরে তিনি বলেছিলেন- ‘তোমার সব ধন-সম্পদ যদি তাদের দিয়ে দাও তবুও তাঁদের হক আদায় করতে পারবে না।’

হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এক ইয়েমেনি ব্যক্তিকে এ অবস্থায় কাবা ঘর তওয়াফ করতে দেখলেন যে, তার পিঠে তার মাকে বহন করছেন আর বলছেন-
‘আমি (আমার মায়ের) বাধ্য উট স্বরূপ। যদিও উট তার সাওয়ারিকে ফেলে পলায়ন করে কিন্তু আমি ঐ রকম করবো না। এরপর ওই ব্যক্তি বললেন, হে ইবনু ওমর! আপনি কি মনে করেন যে, আমি আমার মাতার প্রতিদান দিয়েছি। তদুত্তরে তিনি বললেন, তোমাকে প্রসব করার সময় তার দীর্ঘ একটি শ্বাস কষ্টের প্রতিদানও দাওনি।

বাবা-মায়ের আনুগত্য করা ওয়াজিব
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার হজরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নয়টি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন। তার মধ্যে একটি হলো-
‘… তোমার বাবা-মায়ের আনুগত্য করো। যদি তাঁরা তোমাকে তোমার দুনিয়ার (যাবতীয় কাজ) থেকে বের হয়ে যেতে বলে তবে তাঁদের নির্দেশ পালনার্থে তাই করবে।… ’ (আদাবুল মুফরাদ)

আর যারা একান্তই মহান আল্লাহর নির্দেশ এবং বাবা-মায়ের প্রতি কোনো বিষয় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে না তাদের জন্য হাদিসে পাকে রয়েছে অভিশাপ ও কঠিন সতর্কবার্তা। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবাধ্য সন্তানের ব্যাপারে তিনবার বদ-দোয়ার কথা বলেছেন। এ সম্পর্কে হাদিসের দিকনির্দেশনা এমন-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সে ব্যক্তির নাক ধূলায় মলিন হোক, সে ব্যক্তির নাক ধূলায় মলিন হোক, সে ব্যক্তির নাক ধূলায় মলিন হোক; যে ব্যক্তি তার বাবা-মাকে উভয়কে কিংবা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় জীবিত পেলো; অথচ সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না।’ (মুসলিম)

মনে রাখতে হবে
বাবা-মায়ের সঙ্গে ইহসান তথা ন্যায়-সঙ্গত আচরণ ও আনুগত্য করা জরুরি। আর এর মাধ্যমেই জান্নাতের নিশ্চয়তা পাবে মুমিন। কেননা সন্তানের প্রধান দায়িত্বই হলো- বাবা-মায়ের আনুগত্য করা; তাদের প্রতি ইহসান করার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা করা। কারণ বাবা-মায়ের প্রতি অবাধ্যতাই হবে জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

তাই বাবা-মা জীবিত থাকলে তাদের খেদমত করবে। তাদের প্রতি দয়া দেখাবে। তাদের খোঁজ-খবর নেবে। জীবিত কিংবা মৃত সব বাবা-মায়ের জন্য সন্তান সব সময় এভাবে দোয়া করবে-
১. رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
উচ্চারণ : ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’
অর্থ : (হে আমাদের) পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া কর; যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৪)

২. رَبَّنَا ٱغْفِرْ لِى وَلِوَٰلِدَىَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ ٱلْحِسَابُ
উচ্চারণ : ‘রাব্বানাগফিরলি ওয়ালিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিলমুমিনিনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব।’
অর্থ : ‘হে আমাদের রব! যেদিন হিসাব কায়েম হবে, সেদিন আপনি আমাকে, আমার বাবা-মাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪১)

৩. رَّبِّ ٱغْفِرْ لِى وَلِوَٰلِدَىَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيْتِىَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَٰتِ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّٰلِمِينَ إِلَّا تَبَارًۢا
উচ্চারণ : ‘রাব্বিগফিরলি ওয়ালিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিমান দাখালা বাইতিয়া মুমিনাও ওয়া লিলমুমিনিনা ওয়াল মুমিনাত ওয়া লা তাযিদিজ জ্বালিমিনা ইল্লা তাবারা।’
অর্থ : ‘হে আমার রব! আমাকে, আমার বাবা-মাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন আর আপনি জালিমদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না।’ (সুরা নুহ : আয়াত ২৮)

বিশেষ করে
শুধু বাবা-মায়ের জন্য দোয়া ও খেদমতই নয় বরং বাবা-মায়ের আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রাখা জরুরি। বাবা-মায়ের আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সন্তানের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। হাদিসের বর্ণনা থেকে তা সুস্পষ্ট-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَصِلَ أَبَاهُ فِي قَبْرِهِ،فَلْيَصِلْ إِخْوَانَ أَبِيهِ بَعْدَهُ
‘যে ব্যক্তি তার বাবার সঙ্গে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালোবাসে, সে যেন বাবার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সুসম্পর্ক রাখে।’ (ইবন হিববান)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে বাবা-মায়ের খেদমত করার তাওফিক দান করুন। তাদের খেদমত করার এবং তাদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

নিউজবিজয়২৪/এফএইচএন