বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবনী বিশ্লেষণে কবিতার যথার্থ প্রতিফলন দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রেণু। আমার বঙ্গমাতা। ছিলেন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল অসামান্য মহীয়সী নারী। খুবই কম বয়সে বাবা-মা হারিয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। চাচাতো ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেনু যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান।একমাত্র রইলেন তার দাদা।দাদা ও রেনুর ৭ বছর বয়সে মারা যান। তারপর,সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেনু বড় হন। রেনুর বড়বোনের আমার এক চাচাতো ভাইযের সাথে বিবাহ হয়। এরা আমার শাশুর বাড়ীতে থাকল,কারন আমার রেনুর বাড়ী দরকার নাই।রেনুর ঘর আমার ঘর পাশাপাশি ছিল,মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান।
১৯৩৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বয়স ১৯ ও ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বয়স ৯ আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে হয়। আজীবন দুজনের সম্পর্ক ছিল অতিমধুর। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পরও বেগম মুজিব কখনো মুখ ফুটে ‘আহ্!’ শব্দটি করেননি। তাঁদের সংসার আলো করে একে একে জন্ম নেন শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বেশ প্রভাব ছিল। স্বামীর প্রতিটি অর্জনের পেছনে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। মাসের পর মাস কারান্তরীণ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পরিবারের হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করা, তাদের দেখভাল, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযত্ন কোনোটাই কম করেননি।
ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ততার মাঝেও ভুলে যাননি স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। মনটা সব সময়ই তাঁর জন্য কাঁদতো। বঙ্গবন্ধু কারাগারে কেমন আছেন, সুস্থ আছেন কিনা-এসব খোঁজ-খবর রাখতেন। কারণ স্বামীর জন্য ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা মায়া। একবার একনাগাড়ে ১৭ থেকে ১৮ মাস কারাগারে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এসময় স্বাস্থ্য বেশ খারাপ হয়েছিল। এ অবস্থা দেখে বেগম মুজিব কষ্ট পান। স্বামীকে বলেন, ‘জেলে থাকো,আপত্তি নেই। তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন... তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?’ শুনে বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, ‘খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি?
বেগম মুজিব সংসারে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেক কষ্ট করতেন। কিন্তু স্বামীকে কিছুই বলতেন না। নিজে কষ্ট করে স্বামীর জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখতেন। যাতে স্বামীর কষ্ট না হয়। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীই ছিলেন না। ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সুখ-দুঃখের সাথী।
মুখে কিছু না বললে ও বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতেন। আত্মজীবনী লিখেছেন, ‘সে (রেণু) তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণার পেছনেও আছে বেগম মুজিবের সময়োচিত ভূমিকা। রাজনীতির সংকটময় মুহূর্তে সাহস ও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় যোগদানের জন্য রওনা দেওয়ার সময় বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, তাদের নিরাশ করো না। যা বলার চিন্তাভাবনা করেই বলবে।(তথ্য সুত্র-আমিনুল হক বাদশাহ ভাইর কাছ থেকে শুনা)
এভাবে বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তে কথা দিয়ে, পাশে থেকে বঙ্গবন্ধুকে সাহস জুগিয়েছেন,যে কারণে জীবনের কথা লিখতে গিয়ে বারবার রেণুর প্রসঙ্গ টেনেছেন। এমনকি অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মতো অসামান্য জীবনকথা লেখার পেছনেও বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল। জেলগেটে স্বামীকে লেখার জন্য খাতা দিয়ে এসেছিলেন। বারবার অনুরোধের পর বঙ্গবন্ধু আঁকতে শুরু করেছিলেন বর্ণাঢ্য জীবনের চিত্র।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব এর মতো ধীরস্থির, বুদ্ধিদীপ্ত, দূরদর্শী, নারীর সাহসী, বলিষ্ঠ, নির্লোভ ও নিষ্ঠাবান ইতিবাচক ভূমিকা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হতে সহায়তা করেছে। জনগণের কল্যাণে সমগ্র জীবন অকাতরে দুঃখবরণ এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। সেই বিবেচনায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মরণীয় একটি নাম। একটি ইতিহাস। মনেপ্রাণে একজন আদর্শ নারী। সন্তানদের সার্থক মাতা। বিচক্ষণ উপদেষ্টা ও পরামর্শদানকারী। সাহসী বঙ্গমাতা। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর সুখ-দুঃখের সাথী এবং বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা ও শক্তির উৎস ছিলেন এই মহীয়সী নারী।
তার সদয় আচরণ ও বিনয়ে মুগ্ধ ছিল সবাই। সন্তানদের যেমনি ভালবেসেছেন তেমনি শাসন করেছেন। পিতা মাতা উভয়েরই কর্তব্য শেষ দিন পর্যন্ত পালন করে গেছেন। বেগম মুজিব ছিলেন কোমলে কঠোরে মিশ্রিত এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সাহসী নারী। স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সন্তানদের গড়ে তোলেন। তার কাছে সহযোগিতা চেয়ে কেউ কখনও রিক্ত হস্তে ফিরে যায়নি। কারাগারে আটক দলীয় নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেয়া থেকে শুরু করে পরিবার-পরিজনদের যে কোন সংকটে পাশে দাঁড়াতেন। বহু কন্যাদায়গস্ত পিতাকে ও ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য তিনি সহযোগিতা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে জাতির পিতার হত্যাকারীদের হাতে বেগম মুজিবও নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। কিন্তু বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম প্রেরণাদায়িনী মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
৮ আগস্ট। মহিয়সী নারীর ৯২তম জন্মদিন। ১৯৩০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া আলোকিত করেছিলেন। সেদিন জন্মেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু জীবন সঙ্গিনী। বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির জনক, বিশ্ববরণ্য নেতা বাংলাদেশ, বাঙ্গালী ও বাংলা ভাষা প্রেরনার উৎস বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: এস এম সুজন
শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক
যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ।
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
E-mail :- [email protected] । E-mail :- [email protected] মোবাইল- +৮৮০১৭১৩-৬৩৬৬৬১ । বার্তা বিভাগ :- +০১৭১৬-৯৮০০৮৮ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ের বিধি মোতাবেক নিবন্ধনের জন্য আবেদিত NewsBijoy24.Com - Popular Online Newspaper of Bangladesh.