রমজান মাসের তারাবির নামাজ নিয়ে অনেক মতভেদ থাকলেও ইসলামের নির্ভরযোগ্য দলিল অনুযায়ী বিশ রাকাত তারাবি নামাজই প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য। প্রামাণ্য হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবিরা বিশ রাকাত তারাবি নামাজ আদায় করেছেন।
তারাবি নামাজের অর্থ ও পরিচিতি
আরবি ‘তারাবিহ’ শব্দটি এসেছে ‘রাহাতুন’ শব্দমূল থেকে, যার অর্থ বিশ্রাম। দীর্ঘ নামাজ পড়ার সময় প্রতি চার রাকাত পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার কারণে একে ‘তারাবি নামাজ’ বলা হয়।
তারাবির রাকাত সংখ্যা: বিশুদ্ধ দলিল
১. সাহাবি সায়েব ইবনে ইয়াজিদ (রা.) বলেন, হজরত উমর (রা.)-এর যুগে মুসলিমরা বিশ রাকাত তারাবি আদায় করতেন। (আস সুনানুল কুবরা, বাইহাকি)
২. হজরত উসমান (রা.)-এর সময়ও বিশ রাকাত তারাবি পড়া হতো এবং দীর্ঘ সময় ধরে কোরআন তিলাওয়াত করা হতো।
৩. হজরত আলী (রা.)-ও বিশ রাকাত তারাবির অনুমোদন দেন এবং মুসল্লিদের তা আদায়ের নির্দেশনা দেন।
আট রাকাত তারাবি: একটি বিভ্রান্তি
১. প্রথমবার ভারতবর্ষের কিছু আহলে হাদিস আলেম ১২৮৪ সালে আট রাকাতের ফতোয়া দেন, যা আগে কোথাও প্রচলিত ছিল না।
২. যেসব হাদিসে আট রাকাত নামাজের উল্লেখ আছে, তা আসলে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য প্রযোজ্য, তারাবির জন্য নয়।
৩. মক্কা ও মদিনার প্রধান মসজিদসহ বিশ্বজুড়েই বিশ রাকাত তারাবি পড়ার প্রচলন রয়েছে।
তারাবির বিধান ও গুরুত্ব
সুন্নতে মুয়াক্কাদা: বিশ রাকাত তারাবি নামাজ আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। বিনা ওজরে এর কম পড়া গুনাহের শামিল।
জামাতে তারাবি: জামাতে পড়া মুস্তাহাব, তবে একাকী পড়লেও নামাজ আদায় হয়ে যাবে।
নারীদের জন্য: নারীরাও বিশ রাকাত তারাবি আদায় করতে পারেন, তবে পুরুষদের মতো তাদের জন্য জামাত বাধ্যতামূলক নয়।
নাবালেগ ইমামের পেছনে নামাজ: কোনো নাবালেগ হাফেজের পেছনে প্রাপ্তবয়স্কদের তারাবি পড়া বৈধ নয়।
বাংলাদেশে তারাবির নিয়ম
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রথম ছয় দিনে দেড় পারা করে এবং বাকি ২১ দিনে এক পারা করে তারাবি পড়ার নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে। এতে মুসল্লিরা একই নিয়মে খতমে তারাবিতে অংশ নিতে পারেন।
বিশ রাকাত তারাবির প্রচলনই ইসলামের নির্ভরযোগ্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। যারা আট রাকাতের প্রচার করছেন, তারা মূলত তাহাজ্জুদের হাদিসকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছেন। সঠিক ইসলামী অনুশাসন মেনে বিশ রাকাত তারাবি আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব।
——————————————————————————————————
প্রশ্নঃ ১২৭৯৫. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, তারাবি নামাজ কত রাকাত আট রাকাত না বিশ রাকাত? ইদানিং কিছু কিছু মানুষ ৮ রাকাতের কথা বলে। তাদের কথা কতটুতু বাস্তবসম্মত?
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
তারাবির নামাজ ২০ রাকাত। তারাবির নামাজকে আট রাকাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা অনুচিত। পবিত্র রমজান মাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল এই তারাবির নামাজ। এটি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। আল্লাহর রাসুল (সা.) তিন দিন এই নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করেছেন। তিনি নিয়মিত সম্মিলিতভাবে জামাতের সঙ্গে তারাবি নামাজ আদায় করলে, তা ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই পুরো রমজানে তিনি জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করেননি।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারাবির নামাজ পড়ার প্রচলন ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)-এর যুগে। সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তখন আর এটি ফরজ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কেননা মহানবী (সা.)-এর ওফাতের মাধ্যমে ওহির পথ বন্ধ হয়ে যায়।
তাবেঈ ইবনে আবি জুবাব (রহ.) বলেন, ‘ওমর (রা.)-এর যুগে রমজানের তারাবি ছিল ২৩ রাকাত।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৭৩৩)
প্রখ্যাত তাবেঈ আবদুল আজিজ ইবনে রুফাই (রহ.) বলেন, ‘উবাই ইবনে কাব (রা.) রমজানে মদিনায় লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতর পড়তেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : হাদিস : ৭৭৬৬)
পৃথিবীর প্রথম সহিহ হাদিসগ্রন্থ ‘মুয়াত্তা মালিক’সহ অন্যান্য কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, তাবেঈ ইয়াজিদ ইবনে রুমান (রহ.) বলেন, ‘উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে লোকেরা রমজানে ২৩ রাকাত তারাবি পড়তেন।’ (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস : ৩৮০; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকি, হাদিস : ৪২৪৯)
এ ধরনের বহু সহিহ বর্ণনার আলোকে ও সাহাবি-তাবেয়িনের যুগ থেকে চলে আসা অবিচ্ছিন্ন কর্মের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়, উমর (রা.)-এর যুগে মসজিদ-ই-নববীতে ২০ রাকাত তারাবি হতো। এখনো মক্কা-মদিনায় ২০ রাকাত তারাবি হয়। সারা বিশ্বের মুসলমানরা এই সুন্নাত নামাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। বলা যায়, এটি সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাত।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নত দৃঢ়ভাবে ধারণ করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬০৭, তিরমিজি, হাদিস : ২৬৭৬, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৬৬৯২, সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস : ৪২)
সুতরাং তারাবির রাকাত নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। কেননা যেখানে আট রাকাতের কথা আছে, সেটি মূলত তাহাজ্জুদসংক্রান্ত হাদিস। মহানবী (সা.) রমজানে ও রমজানের বাইরে প্রতি রাতে আট রাকাত তাহাজ্জুদ ও তিন রাকাত বিতরের নামাজ পড়তেন। মহান আল্লাহ আমাদের উপলব্ধি ও আমল করার তাওফিক দান করুন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ফাতওয়া বিভাগ
নিউজ বিজয় ২৪ডট কম/এফএইচএন