ইসলামি বর্ষপঞ্জির বা আরবি হিজরি সনের ৩য় মাস হলো রবিউল আউয়াল। এটি অন্যান্য মাস থেকে বেশি গুরুত্ব বহন করে। কারণ, বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মাসেই জন্মগ্রহণ করেছেন এবং এই মাসেই ইন্তেকাল করেন।
পবিত্র কোরআনুল কারিম ও হাদিস শরিফে এই রবিউল আউয়াল মাসের জন্য আলাদা কোনো করণীয় বা আমলের বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাই নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আমলের বর্ণনা দেওয়া শরিয়তে বাড়াবাড়ি এবং হারাম কাজ। তবে নবিজির সিরাত আলোচনা করা একটি বড় ইবাদত। এমনকি এটি ঈমানের অংশও বটে।
ঐতিহাসিকগণ বলেন, তিনি এ মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। কেউ কেউ বলেন ৮ তারিখ। আবার কেউ কেউ বলেছেন ৯ তারিখ। তবে এই মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের পবিত্র জন্মগ্রহণ ছাড়া আরো অনেক ঘটনা রয়েছে।
(১) মসজিদে কুবা নির্মাণ: মদিনার আনসারি সাহাবিরা যখন জানতে পারলেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করছেন। তখন তারা রাসূলকে অভিবাদন জানানোর জন্য প্রতিদিন ‘কুবা’ নামক স্থানে একত্রিত হতেন। সেখানে রাসূলের আগমনের অপেক্ষা করতেন। অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতেন।
অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন রবিউল আউয়াল মাসে ‘কুবা’ নামক স্থানে পৌঁছলেন তখন আমর ইবনে আউফের (রা.) বাড়িতে অবস্থান করেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পর সর্বপ্রথম তিনি মসজিদে কুবা নির্মাণ করার প্রস্তুতি নেন। অতঃপর কুলসুম ইবনে হাদিমের (রা.) জমিতে মসজিদ নির্মাণ করেন।
মসজিদের প্রথম পাথর রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে রাখেন। অতঃপর আবু বকর ও ওমর (রা.) একটি একটি করে পাথর রাখেন। ইসলামে সর্বপ্রথম মসজিদ এটিই যা রবিউল আওয়াল মাসের ৮ তারিখে নির্মিত হয়।
(২) রাসূলের কন্যা উম্মে কুলসুমের (রা.) বিবাহ: তৃতীয় হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে হজরত উসমান (রা.) এর সঙ্গে উম্মে কুলসুমের (রা.) বিয়ে হয়। প্রথমে আবু লাহাবের দ্বিতীয় ছেলে উতাইবা ইবনে আবু লাহাবের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সূরা লাহাব নাযিল হলে এবং তাতে আবু লাহাবকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হলে উতাইবা রাসূলের সঙ্গে বেয়াদবিমূলক আচরণ করে; এবং সঙ্গে সঙ্গে উম্মে কুলসুমকে (রা.) তালাক দিয়ে দেয়।
তার এমন উদ্যতপূর্ণ আচরণের কারণে রাসূলের মুখ থেকে অনিচ্ছায় এ কথা বেড়িয়ে যায় ‘হে আল্লাহ! আমার কুকুরগুলোর মধ্য থেকে কোন কুকুরকে তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দাও’।
এর কিছুদিন পর আবু লাহাব ও তার ছেলে উতাইবা সিরিয়ার উদ্দেশ্যে সফর শুরু করে। পথিমধ্যে বিশ্রামের জন্য একটি জায়গায় সফর বিরতি দেয়। আবু লাহাব কিছুটা দূরে গিয়ে পাহারায় ছিল এমন অবস্থায় হঠাৎ একটি নেকড়ে এসে তার ছেলের মাথাকে দ্বিখণ্ডিত করে নিয়ে যায় এবং সেখানেই সে মারা যায়। (সিরাতে ইবনে হিশাম)
(৩) নবীজির শেষ সন্তান ইব্রাহিমের (রা.) মৃত্যু: ইব্রাহিম (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ সন্তান ছিলেন। তিনি ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ৯ রজব মদিনার নিকটবর্তী আলিয়া নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। নবীপত্নী মারিয়া কিবতিয়ার (রা.) গর্ভ থেকে তিনি জন্মলাভ করেন। আবু রাফে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আজাদকৃত গোলাম ছিলেন।
তিনি ইব্রাহিমের (রা.) জন্মের সুসংবাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দেন; তখন রাসূলুল্লাহ অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকে পুরস্কার স্বরূপ একটি গোলাম হাদিয়া দেন। সুসংবাদ পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই জিব্রাইল (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ‘ইয়া আবা ইব্রাহিম’ অর্থাৎ ইব্রাহিমের পিতা বলে ডাক দেন।
তখন রাসূল (সা.) অত্যন্ত খুশি হন এবং তৎক্ষনাৎ ২টি বকরী আকিকা করেন। মাথার চুল কেটে তার সমপরিমাণ রুপা দান করেন। এরপর দুধ পান করানোর জন্য উম্মে সাইফের (রা.) কাছে সোপর্দ করেন। দুধ পান করানো অবস্থায় রবিউল আউয়াল মাসে তিনি ইন্তেকাল করেন।
(৪) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রিয় সাহাবি মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) এর মৃত্যু: তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অত্যন্ত প্রিয় একজন সাহাবি ছিলেন। তিনি একজন ফক্বিহ তথা ইসলাম ধর্মের পণ্ডিত ছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে একটি কাফেলার প্রধান বানিয়ে ইয়ামিনের দিকে প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি ইসলাম প্রচার করতে থাকেন এবং মানুষদেরকে দ্বীনের পথে ডাকতে থাকেন। লোকজন ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য তার আশপাশে জড়ো হতেন। অবশেষে তিনি ১৮ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তেকাল করেন।
(৫) হজরত জয়নাব বিনতে জাহাশের (রা.) ইন্তেকাল: তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী ছিলেন। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহিপ্রাপ্ত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বিয়ে করেন। বিবাহ পরবর্তী ওলিমা অনুষ্ঠানে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান পর্দার আদেশ নাজিল হয়।
সে অনুষ্ঠানে খাওয়া-দাওয়ার পর কিছু সংখ্যক সাহাবি দীর্ঘ সময় বসে ছিলেন এবং বারবার ঘরে আসা যাওয়া করছিলেন, যার কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলেন। ইচ্ছা থাকা সত্বেও কিছু বলতে পারছিলেন না। মনে মনে চাচ্ছিলেন যে তারা চলে যায়।
এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেন। ‘হে মুমিনগণ! নবীর ঘরে (অনুমতি ছাড়া) প্রবেশ করো না। অবশ্য তোমাদেরকে আহার্যের জন্য আসার অনুমতি দেওয়া হলে ভিন্ন কথা। তখন এভাবে আসবে যে, তোমরা তা প্রস্তুত হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকবে না। কিন্তু যখন তোমাদেরকে দাওয়াত করা হয় তখন যাবে। তারপর যখন তোমাদের খাওয়া হয়ে যাবে তখন আপন-আপন পথ ধরবে; কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়বে না। বস্তুত তোমাদের এ আচরণ নবীকে কষ্ট দেয়, কিন্তু সে তোমাদেরকে (তা বলতে) সঙ্কোচবোধ করে। আল্লাহ সত্য বলতে সঙ্কোচবোধ করেন না। নবীর স্ত্রীগণের কাছে তোমরা কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাবে। এ পন্থা তোমাদের অন্তর ও তাদের অন্তর অধিকতর পবিত্র রাখার পক্ষে সহায়ক হবে। নবীকে কষ্ট দেওয়া তোমাদের জন্য জায়েজ নয়। (সূরা: আহযাব, আয়াত: ৫৩)
নিউজবিজয়২৪ডট কম/এফএইচএন