নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানাধীন গোবান্দি এলাকার বাসিন্দা সাদিকুর সাদির সঙ্গে কারো বিবাদ ছিল না কখনো। এলাকায় ভদ্র ছেলে হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত তিনি। সেই সাদিই এখন জোড়া খুনের মামলার আসামি।
আইপিএল খেলায় জুয়া খেলে নিজের সব টাকা খুইয়ে আরো ৭০ হাজার টাকা ঋণী হয়ে পড়েন সাদি। অসহায় অবস্থায় পাশের বাড়ির ভাবি রাজিয়া সুলতানা কাকুলির কাছে ১০ হাজার টাকা ধার চান। টাকা না পেয়ে স্বর্ণালঙ্কারের লোভে কাকুলি ও তার ৮ বছরের শিশু সন্তান তালহাকে গলা কেটে হত্যা করেন সাদি।
গত ২ জুলাই রাতে গোবান্দি এলাকার নিজ বাসায় কাকুলি ও তার শিশু সন্তান তালহাকে খুন করা হয়। ঘটনার তদন্তে কাকুলির ঘরের পাশে একটি সুপারি গাছে লাগা মাটি দেখে ক্লু-লেস এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পরে শনিবার (৯ জুলাই) নিজ বাসা থেকে সাদিকুর সাদিকে গ্রেফতার করা হয়। রোববার (১০ জুলাই) হত্যাকাণ্ডে নিজের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সাদি।
সোমবার (১১ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডি পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।
হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় পিবিআই সদস্যরা দেখতে পান কাকুলির ঘরের পেছনে একটি সুপারি গাছে মাটি লেগে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ বেয়ে উঠেছে, কিন্তু গাছে সুপারি নেই। আবার গাছ বেয়ে ঐ ঘরে প্রবেশের সুযোগও নেই। তবে গাছে উঠে ভেন্টিলেটর দিয়ে কাকুলির ঘরের ভেতরটা দেখা যায়।
হত্যাকাণ্ডের সময় গাছ বেয়ে কেউ উঠেছে এমন ধারণা করে খোঁজ করতে থাকেন পিবিআই সদস্যরা। এক পর্যায়ে জানা যায়, বাড়ির পেছনে ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগ থাকায় কাকুলির ভাশুরের ছেলে অজিদ কাজীসহ কয়েকজন সেখানে বসে ভিডিও গেম খেলে।
অজিদ কাজীকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জানায়, ২ জুলাই রাতে সে ঐ ঘরের পেছনে বসে অনলাইনে গেম খেলছিল। আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ কাকুলির ছেলে ভিকটিম তালহার চিৎকার শোনা যায়। এরপর অজিদ কৌতূহলবশত সুপারি গাছ বেয়ে উপরে উঠে ভেন্টিলেটর দিয়ে সাদিকে দেখতে পায়।
এরপর সাদিকে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে অজিদ। সে ভাবে কাকুলির সঙ্গে সাদির অবৈধ সম্পর্ক আছে। পরে তার দেওয়া তথ্যমতে সাদিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
মালয়েশিয়া প্রবাসী স্বামী আড়াই বছর আগে মারা যাওয়ার পর কাকুলি তার সন্তানকে নিয়ে ঐ ঘরেই বসবাস করতেন। তার কাছে টাকা-পয়সা আছে ভেবে ধার চাওয়ার পরিকল্পনা করেন সাদি।
সাদিকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে পিবিআই প্রধান বলেন, ২ জুলাই রাতে কাকুলির ঘরের দরজায় নক করে দরজা খুলতে বলেন সাদি। কাকুলি দরজা খুললে সাদি ভেতরে গিয়ে দেখতে পান তার ছেলে তালহাকে ভাত খাওয়াচ্ছেন। ভাত খাওয়ানোর পর তালহা ঘুমিয়ে যায়। এরপর সাদি কাকুলিকে আরেক রুমে ডেকে নিয়ে ১০ হাজার টাকা ধার চান। তিনি একপর্যায়ে কাকুলির পায়ে ধরে অনুরোধ করেন।
এলাকার ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত হওয়ায় সাদিকে বিশ্বাস করে আলমারি খুলে কাকুলি দেখান তার কাছে দেওয়ার মতো কোন টাকা নেই। মাত্র ১০০ টাকা আছে। আলমারি খুললে সাদি দেখতে পান সেখানে কিছু স্বর্ণালঙ্কার রাখা আছে।
এরপর সাদি তার ভাবি কাকুলিকে চেয়ারে বসতে বলেন। তখন ওড়না দিয়ে কাকুলির গলা পেঁচিয়ে ধরলে সে অজ্ঞান হয়ে যায় এরপর ইস্ত্রি দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে বঁটি দিয়ে গলা কেটে দেন সাদি।
তখন সাদি ভাবে কাকুলির ছেলেও হয়তো তাকে দেখে চিনে ফেলেছে। তাই ঘুমন্ত শিশু তালহাকেও গলা কেটে হত্যা করেন সাদি। এরপর কাকুলির আলমারি থেকে স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে চলে যান। পরে এসব স্বর্ণালঙ্কারের কিছু সাদির ঘর এবং যাদের কাছে বিক্রি করেছেন তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করে পিবিআই।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আইপিএল খেলায় জুয়ায় হেরে প্রায় ৭০ হাজার টাকা ঋণী হয়ে যান সাদি। পাওনাদারদের চাপ সহ্য করতে না পেরে টাকা ধার চাইতে এসে এ হত্যাকাণ্ড ঘটান সাদি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের মনে হয়েছে সাদির হত্যা করার উদ্দেশ্য ছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায় পাওনাদারদের চাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। আমরা তদন্তের এ জায়গাটা বাকি রেখেছি, তদন্তে যদি পাওনাদারদের কোনো ভূমিকা পাওয়া যায় তাহলে তাদেরকেও আসামি করা হবে।