ঢাকা ০৮:০১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গণপরিবহনে ৬৩.৪ শতাংশ নারী হয়রানির শিকার

ফাইল ছবি

রাজধানীতে গণপরিবহনে গত ৬ মাসে ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী বিভিন্ন ধরনের হয়রানি-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশকে। আর ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ বুলিং, ১৫ দশমিক ২ শতাংশ সামাজিক বৈষম্য, ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ লিঙ্গ বৈষম্য এবং ৮ দশমিক ২ শতাংশ বডি শেমিংয়ের মতো হয়রানির শিকার হয়েছেন।

‘ঢাকা শহরে গণপরিবহনে হয়রানি : কিশোরী এবং তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শিরোনামে আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

আজ শুক্রবার আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে এই জরিপ প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

সংস্থাটি জানায়, জরিপ প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকার বাস, ট্রেন, লেগুনা, রাইড শেয়ারিং ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আজিমপুর, মিরপুর, গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি, বারিধারাসহ বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবী নারী ও কিছুসংখ্যক গৃহবধূর ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়।

আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, জরিপে ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৮০৫ নারী অংশ নেন। এরমধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৬ শতাংশ। জরিপ শুরুর সময়ের ৬ মাস আগ পর্যন্ত হয়রানির মুখামুখি হয়েছেন এমন নারীদের তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। অফলাইন ও অনলাইনে জরিপ করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। জরিপটি পরিচালনা করা হয় এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। এসব যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনে ওঠা-নামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, বাসে জায়গা থাকার পরও যাত্রীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, বাজেভাবে স্পর্শ করা, ধাক্কা দেওয়া ও বাজে মন্তব্য। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ নারী ঝামেলা এড়াতে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেননি।

সংস্থাটি জানায়, যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। গণপরিবহনের চালক ও চালকের সহকারীর (হেল্পার) হাতেও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন অনেকে। নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা বেশি।

আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের ৭৫ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদেরকে অন্য যাত্রীদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ২০ দশমিক ৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদেরকে গণপরিবহনের হেল্পার কর্তৃক এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এছাড়াও ৩ শতাংশ হকারের মাধ্যমে এবং ১ দশমিক ৬ শতাংশ ড্রাইভারের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

‘গণপরিবহনকে অনিরাপদ করে তোলার পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হলেন সাধারণ যাত্রীরা’-উল্লেখ করা হয় জরিপ প্রতিবেদনে।

কারা বেশি যৌন হয়রানি করছে, এই প্রশ্নের উত্তরে দেখা গেছে- ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন যে, তারা ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ জানিয়েছেন যে, তারা কিশোর ও যুবক অর্থাৎ ১৩ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। নিপীড়নের ক্ষেত্রে মধ্যবয়সীরা এগিয়ে থাকলেও কিশোর তরুণদের মাধ্যমে এই হার কম নয়।

গণপরিবহনে কিশোরী ও তরুণীদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ জানিয়েছেন, বাসে ওঠা-নামার সময় অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও হেল্পাররা স্পর্শ করেছেন। ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তাদেরকে গত ৬ মাসে অন্তত ৩ বার এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে। নারী যাত্রীদের ওঠানোর ক্ষেত্রে হেল্পারদের বাস থেকে নেমে যাওয়া আবশ্যক হলেও তাদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান।

গণপরিবহনে কোন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে- সে বিষয়ে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, গণপরিবহনে চলাচলের সময় তাদেরকে আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করা হয়েছে। ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, গণপরিবহনে যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও অন্য যাত্রীরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের গা ঘেঁষে দাঁড়ান। ইচ্ছাকৃতভাবে হালকাভাবে স্পর্শ করে গেছেন ১৭ দশমিক ৯ শতাংশকে।

এছাড়াও ১৪ দশমিক ২ শতাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কার শিকার হয়েছেন। ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন যে, তারা বাজে মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।

আঁচল ফাউন্ডেশন জরিপের পরিসংখ্যান মতে, গণপরিবহনে হালকা ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কিশোরী ও তরুণীরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন, যা ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। অতিরিক্ত ভিড় যৌন হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ২ শতাংশের ক্ষেত্রে। বসে থাকা অবস্থায় যৌন নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। গণপরিবহনে ওঠা বা নামার সময় ১১ দশমিক ৩ শতাংশ নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। গণপরিবহনে সিটের অতিরিক্ত লোক নেওয়ার ফলে যৌন হয়রানি বাড়ছে বলেও তথ্য ওঠে এসেছে জরিপে।

আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীদের প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে দেখা যায়, ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ ভয় পাওয়ার কারণে নীরব থেকেছেন। ২০ দশমিক ৪ শতাংশ পরবর্তীতে সেই গণপরিবহন এড়িয়ে চলেছেন। ৪ দশমিক ২ শতাংশ পার্শ্ববর্তী সহযাত্রীদের কাছে সাহায্যের অনুরোধ করেছেন। অন্যদিকে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছেন। কোনো অন্যায়ের শিকার হওয়ার পরও কিশোরী ও তরুণীদের কোনো ধরনের প্রতিবাদ না করার সংখ্যাটাও কম নয়। নারীদেরকে প্রতিবাদী না হতে শিখালে তাদের হয়রানির শিকার হওয়ার হার বাড়তে পারে বলেও জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সংগ্রহকৃত তথ্য থেকে জানা যায়, ২১ দশমিক ২ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী গণপরিবহন ব্যবহারের সময় যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কারণে পরবর্তীতে ট্রমাটাইজড হয়েছেন। ২৯ দশমিক ৪ শতাংশের মনে গণপরিবহন এক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ হীনমন্যতায় এবং ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ বিষণ্ণতায় ভুগেছেন বলে শেয়ার করেছেন।

অনুষ্ঠানে জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য ফারজানা আক্তার।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মো. ইসমাইল হোসাইন বলেন, ‘জরিপে যা উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। সমাজে জেন্ডার ভারসাম্য ও সমতার বিষয়টি যে নেই, তা এ তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য আইনি ও সামাজিকভাবে উপায় বের করতে হবে। সামাজিক উপায় হিসেবে সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দূর করতে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’

আরেক অতিথি আইনজীবী শাইখ মাহদি বলেন, ‘গণপরিবহনে নারী হয়রানি ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো আইনি প্রতিকার নেই। তবে দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছু ধারায় এ ধরনের কিছু হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অনেক নারী আরও হয়রানির ভয়ে বা আইনি ব্যবস্থা নিয়ে ছোটাছুটি করার ঝামেলা এড়াতে প্রতিবাদ করতে সাহসী হন না। নীরব থাকলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।’

‘তাই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, ৯৯৯ বা ১০৯ এ কল করে সাহায্য চাওয়া এবং আইনি ব্যবস্থা নিতে কিছু প্রমাণ জোগাড় করা, যেমন মোবাইল ফোনে ভিডিও করা বা কথা রেকর্ড করে রাখার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারেন নারীরা। এসব প্রমাণ উপস্থাপন করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার পাওয়া যায়।’

আঁচল ফাউন্ডেশন অনুষ্ঠানে গণপরিবহনে হয়রানি প্রতিরোধে ১০ দফা প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- পরিবহনে আসনের বেশি যাত্রী না তোলা, গণপরিবহনের ভেতর ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো, নারীদের জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করা, বাসের চালক, তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারীর পরিচয় উল্লেখ করে নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া ইত্যাদি।

নিউজবিজয়/এফএইচএন

👉 নিউজবিজয় ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন ✅

আপনার সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার দিন।

NewsBijoy24.Com

নিউজবিজয়২৪.কম একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যভিত্তিক সংবাদ প্রকাশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। উৎসর্গ করলাম আমার বাবার নামে, যাঁর স্নেহ-সান্নিধ্যের পরশ পরিবারের সুখ-দু:খ,হাসি-কান্না,ব্যথা-বেদনার মাঝেও আপার শান্তিতে পরিবার তথা সমাজে মাথা উচুঁ করে নিজের অস্তিত্বকে মেলে ধরতে পেরেছি।

এবার রাষ্ট্রপতির অপসারণ চাইলেন সারজিস আলম

গণপরিবহনে ৬৩.৪ শতাংশ নারী হয়রানির শিকার

প্রকাশিত সময় :- ০৮:৩৮:১৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ জুন ২০২২

রাজধানীতে গণপরিবহনে গত ৬ মাসে ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী বিভিন্ন ধরনের হয়রানি-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশকে। আর ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ বুলিং, ১৫ দশমিক ২ শতাংশ সামাজিক বৈষম্য, ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ লিঙ্গ বৈষম্য এবং ৮ দশমিক ২ শতাংশ বডি শেমিংয়ের মতো হয়রানির শিকার হয়েছেন।

‘ঢাকা শহরে গণপরিবহনে হয়রানি : কিশোরী এবং তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শিরোনামে আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

আজ শুক্রবার আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে এই জরিপ প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

সংস্থাটি জানায়, জরিপ প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকার বাস, ট্রেন, লেগুনা, রাইড শেয়ারিং ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আজিমপুর, মিরপুর, গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি, বারিধারাসহ বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবী নারী ও কিছুসংখ্যক গৃহবধূর ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়।

আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, জরিপে ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৮০৫ নারী অংশ নেন। এরমধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৬ শতাংশ। জরিপ শুরুর সময়ের ৬ মাস আগ পর্যন্ত হয়রানির মুখামুখি হয়েছেন এমন নারীদের তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। অফলাইন ও অনলাইনে জরিপ করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। জরিপটি পরিচালনা করা হয় এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। এসব যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনে ওঠা-নামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, বাসে জায়গা থাকার পরও যাত্রীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, বাজেভাবে স্পর্শ করা, ধাক্কা দেওয়া ও বাজে মন্তব্য। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ নারী ঝামেলা এড়াতে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেননি।

সংস্থাটি জানায়, যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। গণপরিবহনের চালক ও চালকের সহকারীর (হেল্পার) হাতেও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন অনেকে। নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা বেশি।

আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের ৭৫ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদেরকে অন্য যাত্রীদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ২০ দশমিক ৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদেরকে গণপরিবহনের হেল্পার কর্তৃক এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এছাড়াও ৩ শতাংশ হকারের মাধ্যমে এবং ১ দশমিক ৬ শতাংশ ড্রাইভারের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

‘গণপরিবহনকে অনিরাপদ করে তোলার পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হলেন সাধারণ যাত্রীরা’-উল্লেখ করা হয় জরিপ প্রতিবেদনে।

কারা বেশি যৌন হয়রানি করছে, এই প্রশ্নের উত্তরে দেখা গেছে- ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন যে, তারা ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ জানিয়েছেন যে, তারা কিশোর ও যুবক অর্থাৎ ১৩ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। নিপীড়নের ক্ষেত্রে মধ্যবয়সীরা এগিয়ে থাকলেও কিশোর তরুণদের মাধ্যমে এই হার কম নয়।

গণপরিবহনে কিশোরী ও তরুণীদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ জানিয়েছেন, বাসে ওঠা-নামার সময় অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও হেল্পাররা স্পর্শ করেছেন। ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তাদেরকে গত ৬ মাসে অন্তত ৩ বার এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে। নারী যাত্রীদের ওঠানোর ক্ষেত্রে হেল্পারদের বাস থেকে নেমে যাওয়া আবশ্যক হলেও তাদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান।

গণপরিবহনে কোন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে- সে বিষয়ে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, গণপরিবহনে চলাচলের সময় তাদেরকে আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করা হয়েছে। ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, গণপরিবহনে যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও অন্য যাত্রীরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের গা ঘেঁষে দাঁড়ান। ইচ্ছাকৃতভাবে হালকাভাবে স্পর্শ করে গেছেন ১৭ দশমিক ৯ শতাংশকে।

এছাড়াও ১৪ দশমিক ২ শতাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কার শিকার হয়েছেন। ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন যে, তারা বাজে মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।

আঁচল ফাউন্ডেশন জরিপের পরিসংখ্যান মতে, গণপরিবহনে হালকা ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কিশোরী ও তরুণীরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন, যা ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। অতিরিক্ত ভিড় যৌন হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ২ শতাংশের ক্ষেত্রে। বসে থাকা অবস্থায় যৌন নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। গণপরিবহনে ওঠা বা নামার সময় ১১ দশমিক ৩ শতাংশ নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। গণপরিবহনে সিটের অতিরিক্ত লোক নেওয়ার ফলে যৌন হয়রানি বাড়ছে বলেও তথ্য ওঠে এসেছে জরিপে।

আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীদের প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে দেখা যায়, ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ ভয় পাওয়ার কারণে নীরব থেকেছেন। ২০ দশমিক ৪ শতাংশ পরবর্তীতে সেই গণপরিবহন এড়িয়ে চলেছেন। ৪ দশমিক ২ শতাংশ পার্শ্ববর্তী সহযাত্রীদের কাছে সাহায্যের অনুরোধ করেছেন। অন্যদিকে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছেন। কোনো অন্যায়ের শিকার হওয়ার পরও কিশোরী ও তরুণীদের কোনো ধরনের প্রতিবাদ না করার সংখ্যাটাও কম নয়। নারীদেরকে প্রতিবাদী না হতে শিখালে তাদের হয়রানির শিকার হওয়ার হার বাড়তে পারে বলেও জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সংগ্রহকৃত তথ্য থেকে জানা যায়, ২১ দশমিক ২ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী গণপরিবহন ব্যবহারের সময় যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কারণে পরবর্তীতে ট্রমাটাইজড হয়েছেন। ২৯ দশমিক ৪ শতাংশের মনে গণপরিবহন এক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ হীনমন্যতায় এবং ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ বিষণ্ণতায় ভুগেছেন বলে শেয়ার করেছেন।

অনুষ্ঠানে জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য ফারজানা আক্তার।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মো. ইসমাইল হোসাইন বলেন, ‘জরিপে যা উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। সমাজে জেন্ডার ভারসাম্য ও সমতার বিষয়টি যে নেই, তা এ তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য আইনি ও সামাজিকভাবে উপায় বের করতে হবে। সামাজিক উপায় হিসেবে সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দূর করতে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’

আরেক অতিথি আইনজীবী শাইখ মাহদি বলেন, ‘গণপরিবহনে নারী হয়রানি ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো আইনি প্রতিকার নেই। তবে দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছু ধারায় এ ধরনের কিছু হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অনেক নারী আরও হয়রানির ভয়ে বা আইনি ব্যবস্থা নিয়ে ছোটাছুটি করার ঝামেলা এড়াতে প্রতিবাদ করতে সাহসী হন না। নীরব থাকলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।’

‘তাই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, ৯৯৯ বা ১০৯ এ কল করে সাহায্য চাওয়া এবং আইনি ব্যবস্থা নিতে কিছু প্রমাণ জোগাড় করা, যেমন মোবাইল ফোনে ভিডিও করা বা কথা রেকর্ড করে রাখার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারেন নারীরা। এসব প্রমাণ উপস্থাপন করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার পাওয়া যায়।’

আঁচল ফাউন্ডেশন অনুষ্ঠানে গণপরিবহনে হয়রানি প্রতিরোধে ১০ দফা প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- পরিবহনে আসনের বেশি যাত্রী না তোলা, গণপরিবহনের ভেতর ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো, নারীদের জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করা, বাসের চালক, তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারীর পরিচয় উল্লেখ করে নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া ইত্যাদি।

নিউজবিজয়/এফএইচএন